২০১৫ সালের মধ্যে ওয়ানডেতে বিশ্বের সেরা অষ্টম দল হওয়ার স্বপ্ন আয়ারল্যান্ডের

২০১৫ সালের মধ্যে ওয়ানডেতে বিশ্বের সেরা অষ্টম দল, ২০২০ সালের মধ্যে টেস্ট স্ট্যাটাস। পূরণ হবে আয়ারল্যান্ডের স্বপ্ন?

ক্রিকেটের অভিজাত পরিবারে প্রায় এক যুগ হতে চলল, তার পরও বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে। জিম্বাবুয়েকে নিয়েও ওঠে। তবে দুটির প্রেক্ষাপট আলাদা। জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটের দৈন্যদশার কারণে যতটা না ক্রিকেটীয়, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। অবস্থাটা এমন হয়েছে, টেস্ট ক্রিকেটে কোনো খেলোয়াড়ের রেকর্ড নিয়ে আলোচনায় বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পারফরম্যান্সকে বাদ রাখাটা অলিখিত নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্যাপারটা অবশ্যই মন খারাপ করে দেওয়ার মতো। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের পারফরম্যান্স নিয়ে আয়ারল্যান্ডের দুশ্চিন্তা কম নয়! ভবিষ্যতে টেস্ট পরিবারের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধির প্রশ্ন এলেই যে এই উদাহরণ উঠে আসবে। আর এটা এখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিতই যে টেস্ট পরিবার যদি কোনো দিন ১১ জনের একটা পূর্ণাঙ্গ দলে রূপ পায়, ১১তম দেশটি হবে আয়ারল্যান্ড। কেনিয়ার মতো পথ হারিয়ে ফেললে অবশ্য ভিন্ন কথা।

১৯৯৭ আইসিসি ট্রফির আগ পর্যন্ত শুধু জাতীয় দলের পারফরম্যান্সের হিসাবে কেনিয়া বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়েই ছিল। বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পরও অনেক দিন এই দাবি করার যৌক্তিক কারণ ছিল কেনিয়ানদের। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ায় তো শুধু জাতীয় দলের পারফরম্যান্সই বিবেচ্য হয় না; সে দেশের ক্রিকেট-সংস্কৃতি, ক্রিকেটের শিকড় কত দূর বিস্তৃত—এমন আরও অনেক বিবেচনাই থাকে। কেনিয়া মার খেয়ে গেছে এখানেই। প্রশাসনিক দুর্বলতায় আইসিসির সহযোগী সদস্যদেশগুলোর মধ্যে সেরার মর্যাদাও হারিয়ে ফেলেছে।

এই স্বীকৃতিটা এখন সন্দেহাতীতভাবে আয়ারল্যান্ডের প্রাপ্য। ২০০৭ ও ২০১১ বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সে বড় দলগুলোর কাছেও আয়ারল্যান্ড একেবারে হেলাফেলার দল নয়। ক্রিকেট আয়ারল্যান্ডের চিন্তাভাবনায় যে পেশাদারির ছাপ, তাতে কেনিয়ার মতো পরিণতির ভয়ও নেই বলেই মনে হচ্ছে। ২০২০ সালের মধ্যে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার যে ঘোষিত লক্ষ্য, সেটিকেও তাই একেবারে পূরণ অসম্ভব বলা যাচ্ছে না। ক্রিকেট আয়ারল্যান্ডের লক্ষ্যগুলো যে খুব স্পষ্ট। সেই লক্ষ্য অর্জনের সময়সীমাও ঠিক করা আছে।

২০১২ সালের আইরিশ ক্রিকেট অ্যানুয়ালের শুরুতে ক্রিকেট আয়ারল্যান্ডের প্রধান নির্বাহী ওয়ারেন ডিউট্রমের একটা প্রতিবেদন আছে। তাতে তিনি ২০১৫ সাল নাগাদ মূল যে লক্ষ্যগুলোর কথা বলেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
 ওয়ানডেতে বিশ্বের অষ্টম সেরা দল হওয়া।
 ঘরোয়া প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট চালু করা।
 খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৫০ হাজারে উন্নীত করা।
 ক্রিকেটে আয়ারল্যান্ডের চতুর্থ বড় খেলায় পরিণত করা

(এ লেখাটায় কোনোভাবেই আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশকে মেলাব না প্রতিজ্ঞা ছিল। কিন্তু ক্রিকেট আয়ারল্যান্ডের লক্ষ্যগুলোর কথা লিখতে লিখতে মনে প্রশ্ন জাগছে, কই, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে তো কখনো বলতে শুনিনি, অত সালের মধ্যে আমরা টেস্টের এত নম্বর হতে চাই, ওয়ানডেতে এত নম্বর।)

প্রথম লক্ষ্যটা নির্ধারণের সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। সেটি ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের সঙ্গে সম্পর্কিত। ২০১৫ বিশ্বকাপে শুধু আইসিসির পূর্ণ সদস্য ১০টি দলই খেলবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েই গিয়েছিল। তিন মাস তোলপাড়ের পর সেই সিদ্ধান্ত বদলেছে আইসিসি। সহযোগী সদস্য চারটি দলও থাকছে অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে। আইসিসির এই ডিগবাজি আয়ারল্যান্ডের কারণেই। ২০০৭ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে সুপার এইট, ২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারানো—আয়ারল্যান্ডের এই পারফরম্যান্সই আইসিসিকে বাধ্য করেছে। ২০১৯ বিশ্বকাপে র‌্যাঙ্কিংয়ের প্রথম ৮টি দল সরাসরি খেলবে, কোয়ালিফাই করতে হবে বাকি দুটি দলকে—এই সিদ্ধান্তের কারণেই হয়তো বিশ্বের অষ্টম সেরা ওয়ানডে দল হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ। 

২০১৫ বিশ্বকাপে খেলার আশা শেষ হয়ে গেলে আয়ারল্যান্ডের ক্রিকেট বড় একটা বিপর্যয়েই পড়ত। গত দুটি বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের কারণে ক্রিকেট এখানে একটু ঢেউ তুলেছে। খেলোয়াড়ের সংখ্যা হয়ে গেছে দ্বিগুণ। কিন্তু দ্বিগুণ হয়েও তা মাত্র ৩০ হাজার! বিশ্বকাপের ‘মুলা’ না থাকলে আইরিশ কিশোর-তরুণদের ক্রিকেটে টেনে আনা আরও কঠিন হয়ে যেত।

‘আরও’ শব্দটা লিখেছি, কারণ কাজটা এখনই যথেষ্ট কঠিন। ২০১৫ সালের মধ্যে ক্রিকেট আয়ারল্যান্ডের বড় চারটি ঘোষিত লক্ষ্যের মধ্যে চতুর্থটিই আপনাকে কারণটা বলে দেবে। ক্রিকেটকে চতুর্থ বড় খেলায় পরিণত করার লক্ষ্যটাই বলে দিচ্ছে, এখন এটি আইরিশ জনমানসে ৫-৬ নম্বরে আছে। বেলফাস্টে পা রাখার পর মাঠের বাইরে ক্রিকেট-উৎসাহী একজনের সঙ্গেও পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। ট্যাক্সি ড্রাইভার, হোটেলের রিসেপশনিস্ট, পাবে পরিচিত হওয়া তরুণ—যাঁকেই জিজ্ঞেস করেছি, একই উত্তর, ‘নো, ক্রিকেট ইজ নট মাই গেম।’

কারও ‘মাই গেম’ ফুটবল, কারও রাগবি। এই দুটিই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। ক্রিকেটকে আরও কোণঠাসা করতে আরও আছে হকি-গলফ-গ্যালিক ফুটবল নানা খেলা। নেইল ও’ব্রায়েন যেমন বললেন, ‘তরুণ প্রজন্মকে ক্রিকেটে টেনে আনা, মানুষের মনে ক্রিকেট ঘিরে আগ্রহ জাগানোই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’ উপমহাদেশে খেলেছেন, বিশ্বকাপের ওই ম্যাচ ও বিপিএলে খেলার সুবাদে বাংলাদেশে ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনার তো প্রত্যক্ষ সাক্ষী। পার্থক্যটা তাই খুব ভালো বুঝতে পারেন, ‘বাংলাদেশে ক্রিকেট হলো ধর্মের মতো। এখানে ক্রিকেটে আগ্রহীরা সমাজের খুব ক্ষুদ্র অংশ।’
উত্তর আয়ারল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অংশ হলেও রাগবির মতো ক্রিকেটটাও উত্তর ও দক্ষিণ আয়ারল্যান্ড মিলেই খেলে। তার পরও দুই আয়ারল্যান্ড মিলিয়ে জনসংখ্যা মাত্র ৫৫ লাখ। তার ওপর আবার এত সব খেলার হাতছানি। ২০১৫ সালের মধ্যে ক্রিকেটারের সংখ্যা ৫০ হাজারে উন্নীত করার লক্ষ্যের কথা বলে ক্রিকেট আয়ারল্যান্ডের প্রধান নির্বাহী তাই নিজেই সেটিকে ‘উচ্চাভিলাষী’ বলে ফেলছেন। 

যারা এখন ক্রিকেট খেলছে, তাদের ধরে রাখার কাজটাও তো সহজ নয়। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার দাবির পক্ষে ক্রিকেট আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় যুক্তিও এটাও। আয়ারল্যান্ডের সেরা ক্রিকেটাররা তো টেস্ট খেলার স্বপ্ন পূরণের জন্য ইংল্যান্ডের হয়ে যেতে পারেন। এড জয়েস যেমন হয়েছিলেন, এউইন মরগান যেমন হয়েছেন। 

শেষ পর্যন্ত আয়ারল্যান্ডের টেস্ট-স্বপ্ন পূরণ হবে কি না কে জানে! উত্তরটা পাওয়ার জন্য সাগ্রহ অপেক্ষায় থাকলাম। আইরিশদের স্বপ্ন যে বাংলাদেশের এই স্বপ্ন পূরণের পথের দিনগুলোকে মনে করিয়ে দেয়!

 প্রথম আলো থেকে সংগৃহীত